অভিবাসীবান্ধব হিসেবে পরিচিত ইউরোপীয় দেশ পর্তুগাল অভিবাসন নীতিতে আরও কঠোর অবস্থান নিচ্ছে। কাজের ভিসা, পারিবারিক পুনর্মিলন এবং ব্রাজিলের নাগরিকদের স্বয়ংক্রিয় বসবাস অনুমতির মতো সুবিধাগুলোতে নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করতে যাচ্ছে দেশটির সরকার। পার্লামেন্টে এই সংশোধনীর পক্ষে আইনপ্রণেতারা ইতোমধ্যে ভোট দিয়েছেন।
সরকারের দাবি, অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ এবং দেশটির শ্রমবাজারকে সুরক্ষিত করতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যদিও এই পদক্ষেপ অভিবাসীদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে এবং রাজনৈতিক মহলে সরকারকে ডানপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ার ইঙ্গিত বলেও দেখা হচ্ছে।
নতুন বিধিনিষেধের মূল দিকগুলো
কাজের ভিসা:
এখন থেকে শুধুমাত্র উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন অভিবাসীরা পর্তুগালে কাজের ভিসার আবেদন করতে পারবেন। কম দক্ষতার কাজে আসা অভিবাসীদের ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
পারিবারিক পুনর্মিলন:
পরিবারকে পর্তুগালে আনার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ কঠোর করা হয়েছে। আগে যেসব শর্ত সহজ ছিল, এখন সেগুলো আরও কঠিন করা হয়েছে।
ব্রাজিলীয় নাগরিকদের জন্য ছাড় বন্ধ:
আগে যেকোনো ব্রাজিলীয় নাগরিক পর্তুগালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বসবাসের অনুমতি পেতেন। নতুন নিয়মে সেই সুযোগও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
নতুন পুলিশ ইউনিট:
অনিয়মিত অভিবাসীদের শনাক্ত ও নির্বাসনের কাজ সহজ করতে একটি বিশেষ পুলিশ ইউনিট গঠনেরও অনুমোদন পেয়েছে সরকার।
পর্তুগিজ নাগরিকত্ব পেতে জটিলতা:
নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রক্রিয়াও আরও কঠোর করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যদিও এ বিষয়ে পার্লামেন্টে আরও আলোচনা প্রয়োজন বলে সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে।
পুরনো সুযোগ বাতিল, নতুন বাস্তবতা
২০১৮ সালে চালু হওয়া একটি নীতিমালায় পর্যটন ভিসায় আসা অভিবাসীরা এক বছর কাজ করে ও সামাজিক নিরাপত্তায় অবদান রাখার পর বৈধ বসবাসের আবেদন করতে পারতেন। বর্তমান সরকার এই সুবিধাটিও সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে দিয়েছে।
এছাড়া গত বছর থেকেই অফিসিয়াল কাজের ভিসা না থাকলে পর্তুগালে নতুন অভিবাসীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ফলে অবৈধভাবে প্রবেশ করে বৈধ হওয়ার যে পথ ছিল, সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে।
সরকারি হিসাবে দেখা গেছে, বর্তমানে পর্তুগালে প্রায় ১৮ হাজার অনিয়মিত অভিবাসী রয়েছেন। এদের মধ্যে বড় অংশই ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও নেপালের নাগরিক। নতুন আইন তাদের জীবন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে।
অভিবাসীদের প্রতিক্রিয়া ও বিক্ষোভ
সরকারের কঠোর অবস্থানে ক্ষুব্ধ পর্তুগালে বসবাসরত অভিবাসীরা ইতোমধ্যে প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন।
গত বছরের অক্টোবরে রাজধানী লিসবনে পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে অভিবাসীদের একটি বড় বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভে অংশ নেয় বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের অভিবাসী সম্প্রদায়।
বাংলাদেশি অভিবাসীরা বিক্ষোভে বাংলাদেশে পর্তুগালের দূতাবাস খোলার দাবি জানান, যাতে পরিবার পুনর্মিলনের প্রক্রিয়া সহজতর হয়।
সরকারের অবস্থান ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী লুইস মন্টিনিগ্রো গত বছরের মার্চে ক্ষমতায় এসে ঘোষণা দিয়েছিলেন—“অভিবাসনের জন্য ‘প্রশস্ত দরজা’ নীতি বন্ধ করা হবে।”
নতুন এই পদক্ষেপগুলো সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দিকেই ইঙ্গিত দেয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এর মধ্য দিয়ে সরকার ডানপন্থার দিকে ঝুঁকছে, যা ইউরোপের অভিবাসনবিরোধী রাজনীতির প্রভাবকেই প্রতিফলিত করছে।
এক সময় অভিবাসন বিষয়ে উদার দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভেতর পর্তুগাল এবং স্পেন সমালোচনার মুখে পড়েছিল। কিন্তু বর্তমানে পর্তুগাল তার অবস্থান দৃশ্যমানভাবে বদলেছে।
অভিবাসনের বর্তমান চিত্র
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষে পর্তুগালে বসবাসরত বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৫০ হাজার, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ।
২০১৭ সাল থেকে এই সংখ্যা চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, অভ্যন্তরীণ চাপে সরকার এখন অভিবাসন নীতিকে আরও নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়।
প্রতিবেদন: আন্তর্জাতিক ডেস্ক
সম্পাদনা: বার্তা বিভাগ
0 মন্তব্যসমূহ