পর্তুগালে অভিবাসন নীতির বড় পরিবর্তন : ৩৪ হাজার অভিবাসীকে বহিষ্কারের নির্দেশ
লিসবন, ৩ জুন:
এক সময় ইউরোপের সবচেয়ে উন্মুক্ত অভিবাসন নীতি থাকা পর্তুগাল এবার কঠোর অবস্থানে। দেশটির সরকার ঘোষণা দিয়েছে, বসবাসের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় ৩৩,৯৮৩ জন অভিবাসীকে বহিষ্কার করা হবে। এরমধ্যে শুধু ব্রাজিলের নাগরিকই রয়েছেন ৫,৩৬৮ জন।
গত বছর মধ্য-ডানপন্থী ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (AD) সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পর্তুগালের অভিবাসন নীতিতে বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। বসবাসের আবেদনগুলো পর্যালোচনার জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।
সরকার জানায়, এখন পর্যন্ত ৫ লাখের বেশি অভিবাসন আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৩৪ হাজার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। প্রত্যাখ্যাত অভিবাসীদের ২০ দিনের মধ্যে দেশ ত্যাগের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পর্তুগালের রাষ্ট্রপতি মন্ত্রী আন্তোনিও লেইতাও আমারো জানান,
“বহিষ্কারের নোটিশ পাওয়া ব্যক্তিদের স্বেচ্ছায় দেশ ছাড়ার সুযোগ দেওয়া হবে। তবে প্রয়োজনে নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে জোরপূর্বক বহিষ্কারও করা হতে পারে।”
ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ এশীয়দের অবস্থা
সবচেয়ে বেশি বসবাসের আবেদন এসেছে ব্রাজিল থেকে। ৭৩,০০০ আবেদনকারীর মধ্যে ৬৮,০০০ জনের আবেদন অনুমোদিত হলেও, ৫,৩৮৬ জনের আবেদন বাতিল হয়েছে।
ভারতীয় অভিবাসীদের অবস্থান সবচেয়ে নাজুক। ২৮,০০০ ভারতীয় আবেদনকারীর মধ্যে প্রায় ৪৬.৬ শতাংশ (প্রায় ১৩,০০০) জনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
এছাড়া বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নেপাল থেকে আসা অভিবাসীদেরও প্রায় ২৫ শতাংশ আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
'আগ্রহ প্রকাশ' পদ্ধতির অবসান
২০১৫ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত বামপন্থী সমাজতান্ত্রিক সরকার পর্তুগালে অভিবাসনের জন্য ‘আগ্রহ প্রকাশ’ (Manifestação de Interesse) নামে একটি ব্যবস্থা চালু রেখেছিল। এ ব্যবস্থায় কেউ পর্তুগালে এসে পড়াশোনা বা কাজ খোঁজার সুযোগ পেলে বসবাসের আবেদন করতে পারতেন।
কিন্তু ২০২৩ সালে ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স সরকার ক্ষমতায় এসে এ ব্যবস্থা বাতিল করে। এখন থেকে পর্তুগালে বসবাস করতে হলে প্রথমে চাকরির চুক্তিপত্র বা কাজের প্রস্তাব থাকতে হবে।
দ্রুত আবেদন নিষ্পত্তির উদ্যোগ
সরকার জানায়, ৪৪৬,০০০ আবেদন পর্যালোচনার মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে ১৬৫,০০০ আবেদন বাতিল হয়েছে অর্থপ্রদানের ঘাটতির কারণে।
বাকিগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে সরকার ২৫টি নতুন সেবা কেন্দ্র চালু করেছে এবং ১,৪০০ কর্মী নিয়োগ দিয়েছে। আজ পর্যন্ত ১,৮৪,০০০ আবেদন নিষ্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ১,৫০,০০০ অনুমোদিত এবং ৩৪,০০০ প্রত্যাখ্যাত।
জনমত ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব
পর্তুগালের অভিবাসন পরিস্থিতি এখন রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। দেশটিতে বিদেশি অভিবাসীর সংখ্যা এক দশকে তিনগুণ বেড়ে ১.৫ মিলিয়নে পৌঁছেছে, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৪ শতাংশ।
মন্ত্রী আমারো বলেন,
“২০১৫ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত অভিবাসন ব্যবস্থা ছিল ইউরোপের মধ্যে অন্যতম উন্মুক্ত। বিশেষ করে ব্রাজিল ও এশিয়ার দেশগুলো থেকে অভিবাসনের প্রবাহ বাড়ায় দেশে অভিবাসনবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন,
“পর্তুগালের অভিবাসন ইতিহাস ছিল একই ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির দেশভিত্তিক। এখন তার প্রকৃতিতেও পরিবর্তন এসেছে। অভিবাসনের এই ব্যাপক প্রবাহ আমাদের সমাজ, অর্থনীতি এবং সাংস্কৃতিক কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন আনছে। এর সঙ্গে বেড়েছে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিদেশি অবদানকারীদের সংখ্যা।”
রাজনৈতিক প্রভাব
অভিবাসন ইস্যুটি পর্তুগালে সাম্প্রতিক নির্বাচনে অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। এতে উগ্র-ডানপন্থী দলগুলোর জনপ্রিয়তা হঠাৎ করে বাড়তে দেখা যায়।
সরকার বলছে, অভিবাসন নীতির এই নতুন কৌশল পর্তুগালের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জনসংখ্যাগত রূপান্তর সামাল দিতে প্রয়োজনীয়।
0 মন্তব্যসমূহ